News Report In Details

#36. চলে গেলেন মহারথী ব্লাড লেস সার্জন ডাঃ কাজল কান্তি চৌধুরী

2 weeks ago

নিজস্ব প্রতিবেদক।। ৯ এপ্রিল, ২০২৫।।

খাজা ইউনুস আলি মেডিকেল কলেজ                      সেশন: ২০২১-২২

৮০ এর দশকে বাংলাদেশের ময়মনসিংহে এক তরুণ সার্জন জানতে পারলেন Jehovah's Witness দের কথা। Jehovah's Witness হচ্ছে এমন এক গোষ্ঠী যারা ধর্মীয় কারণে কখনো ব্লাড ট্রান্সফিউশন করেনা। অর্থাৎ রক্তক্ষরণে মারা যাবে তবুও তারা অন্য কারো রক্ত নিবে না। তখন সেই তরুন সার্জনের চিন্তা হল তাহলে এদের মেজর অপারেশন কিভাবে হবে, কে করবে! মেজর সার্জারির একটা কমপ্লিকেশন হচ্ছে ব্লাড লস। যার চিকিৎসা ব্লাড ট্রান্সফিউশন। তখন তিনি এমন ভাবে নিজেকে গড়ে তোলার শপথ নিলেন যে তিনি যখন অপারেশন করবেন তখন রোগীর ব্লাড লস হবে না। এমন না যে বাংলাদেশে Jehovah's Witness রা বসবাস করেন, বা অদূর ভবিষ্যতে উনার দাঁরা Jehovah's Witness দের সার্জারি হবে। তবুও তিনি নিজেকে ব্লাড লেস সার্জন হিসেবে তৈরি করলেন। যত বড় সার্জারি হোক ব্লাড লস যেন না হয়। এর পরের চ্যালেঞ্জ নিলেন ডায়াথারমি নিয়ে। অপারেশন থিয়েটারে ইলেক্ট্রোকটারিতে যে গ্যাস তৈরি হয় সেটা কার্সিনোজেনিক। যদিও রিস্ক বেনিফিট রেসিওতে সেটা বেশি কিছু নয়। কিন্তু তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন তিনি ব্লাডলেস সার্জারি করবেন এবং সেটা ডায়াথার্মি ব্যবহার না করেই। শুনলে মনে হতে পারে একজন জেনারেল সার্জন কিভাবে ডায়াথার্মি ব্যবহার না করেন তাও ব্লাড লেস সার্জারি! কিন্তু এটাই ছিলেন প্রফেসর কাজল কান্তি চৌধুরী।

তিনি ছোট বড় সবাইকে আপনি করে বলতেন। কাউকে ধমক দিয়েছেন বা কারো সাথে উচ্চ স্বরে কথা বলেছেন বলে দেখিনি কখনো। কিন্তু একদিন উনাকে রাগ করতে দেখেছিলাম, সকালের রাউন্ডে যখন জানলেন এক পোস্ট অপারেটিভ এনিমিক রোগীকে ব্লাড আগের রাতে ট্রান্সফিউশন করা হয়েছে ongoing loss ছাড়াই। হিমোগ্লোবিন ১০ এর কমে রুটিন অপারেশন ছিল উনার খুবই সাধারণ ব্যাপার। MBBS 5th ইয়ার পর্যন্ত আমাদের Bailey and love short practice of surgery এর ২৫তম এডিশন চলছিল। ইন্টার্র্নশিপের সময় আসলো ২৬ এডিশন। যেখানে ২য় অধ্যায়ে আলাদা টেবিল করে ব্লাড ট্রান্সফিউশন এর ক্রাটেরিয়া দেওয়া হল। স্যার বেজায় খুশি। মনে আছে সেদিন স্যার যাকে সামনে পেয়েছিলেন তাকেই বই খুলে দেখিয়েছিলেন। স্যার মাঝে মাঝে একটু হরবর করে কথা বলতেন। “দেখেন দেখেন নতুন এডিশনে কি আসছে দেখেন। আমি কিন্তু বলেছিলাম বইতে আসবে”।

মজার ব্যাপার ছিল সার্জারির ক্লাসে স্যার প্রায়ই ফিজিক্স পড়াতেন। গতি, ভরবেগ, রেডিয়েশন, বিগ ব্যাং আরো অনেক কিছুই যা মনে নাই । ২০০৬ সালের ইমরান হাসমির Gangstar সিনেমার জেমস এর ভিগি ভিগি গান তখনো অনেক জনপ্রিয়। কিন্তু গানটা যে মহিনের ঘোড়া গুলো ব্যান্ডের ১৯৯৫ সালের পৃথিবীটা নাকি ছোট হতে হতে গানের সুর থেকে নেওয়া সেটা তখন আমি না জানলেও স্যার ঠিকই জানতেন। একদিন ক্লাসে বিগ ব্যাং বোঝাইতে গিয়ে বললেন ওই যে জেমসের গানটা শুনেছেন না তার যে বাংলা আছে তারারাও যত আলোক বর্ষ দূরে, তুমি আমি যাই সরে সরে তেমনি কিন্তু তারারা একে অপরের দূরে সরে যাচ্ছে।

প্রফেসর কাজল কান্তি স্যার সার্জারির লোক হলেও মেডিসিনের যেকোন বিষয়ে ভাল দখল ছিল। বাচ্চা প্রসবের দ্রুত নাড়ি কাটা উচিত নাকি দেরি করে নাড়ি কাটা উচিত এটা নিয়ে কন্ট্রাভার্সি সারা দুনিয়ায় সব সময় ছিল। দেশের কমন প্রাকটিস ছিল বাচ্চা প্রসবের পর দ্রুত নাড়ি বেধে দেওয়া। এই কন্ট্রাভার্সি দূর হয় যখন ২০১২, ও ২০১৩ তে যথাক্রমে ইউকে ও অস্ট্রেলিয়ায় দুইটা মেজর স্টাডি পাবলিশ হয়। সেখানে দেখানো হয় Umbilical cord দেরি করে ক্লাম্প করা কত উপকারি এবং কত ধরনের নিওনেটাল কমপ্লিকেশন প্রিভেন্ট করা যায়। কাজল স্যার বরাবরই দেরিতে ক্লাম্প করার পক্ষের লোক ছিলেন। এই পাবলিকেশন আসার পরে স্যার মহা সমারোহে হাসপাতালে একটা মাসিক সেমিনারের আয়োজন করলেন। সেমিনারের নাম দিলেন “Who clamps the monkey’s cord”. খুশির বিষয় World Health Organisation সহ দুনিয়ার মেজর সব গাইনি-অবস সোসাইটির বর্তমান গাইডলাইন এখন Delayed Cord clamp এর পক্ষে।

কাজল স্যার মুখে বলার লোক ছিলেন না, যেটা সঠিক মনে করতেন সেটা করে দেখনোর লোক ছিলেন। সার্জারি মেজর হোক আর মাইনর স্যার সব সময় নিজ হাতে টেবিল থেকে ট্রলিতে পেসেন্ট সিফট করতেন। এবং নিজে পেসেন্টের সাথে রিকোভারি রুমে যেতেন। পৌরসভার লোক কখন এলাকার ড্রেইন পরিষ্কার করবে সে অপেক্ষায় থাকেন নি। সার্জারির প্রফেসর হয়েও বছরের পর বছর নিজ হাতে এলাকার পৌরসভার ড্রেন পরিষ্কার করেছেন। রোগীদের সাথে মজাও করতেন অনেক। রোগী ছুটির সময় মজা করে বলতেন বাসায় গিয়ে স্বামী স্ত্রী ঝগড়া করবেন। কারণ ঝগড়া করলে শ্বাসের ব্যায়াম হয়। যেটা Respiratory physiotherapy এর কাজ করে। মেজর সার্জারির পর Respiratory Physiotherapy খুবই গুরুতপূর্ন।

স্যারের অনেক আইডিয়া বা কথা তখন বুঝি নাই। হাসাহাসি করেছি। যেমন কিছু Major Gut সার্জারির এর পর Fecal Transplantation বা গু দেবার হাইপোথিসিস। যেটা বুঝতে পেরেছি অনেক বছর পর এ বাংলাদেশের আরেক লিজেন্ড বারডেমের প্রফেসর ডক্টর মোহাম্মদ আবু সায়েদ স্যারের সাথে কথা বলতে গিয়ে।

কাজল কান্তি চৌধুরী স্যার গতকাল মারা গিয়েছেন। স্যারের সান্নিধ্য বেশিদিন পাবার সৌভাগ্য হয় নি। যখন পেয়েছিলাম তখন উনার কথা, সার্জিকাল টেকনিক বোঝারও বা শেখার বয়স, ম্যাচুরিটি হয় নাই। এবং উনার সব টেকনিক শেখাও সম্ভব নয় আরেকজনের পক্ষে। অনেক টেকনিকই ছিল যেটা হয়ত উনার পক্ষ্যেই করা সম্ভব ছিল। অসাধারণ মানুষ হয়েও সারা জীবন বিলাসহীন জীবন যাপন করে গিয়েছেন। নিজের থেকে বড় সাইজের সার্ট আর বুক পকেটে মোবাইল আর চশমা। কিন্তু স্যারের অনুপ্রেরণা স্যারের ছাত্র ও কলিগদের মাঝে সারাজীবন থাকবে।

 

ডাঃ সৌরভ ভৌমিক

MS (Vascular Surgery)