নিজস্ব প্রতিবেদক
খাজা ইউনুস আলি মেডিকেল কলেজ
সেশন : ২০২১-২২
মুন্নু হাসপাতালে চিকিৎসকের ভুলে প্রসূতির মৃত্যু!
মানিকগঞ্জ সদর উপজেলার গিলন্ড এলাকায় অবস্থিত ‘মুন্নু মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে’ চিকিৎসকের ভুলে এক প্রসূতির মৃত্যু হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। গত মঙ্গলবার রাত ১০টার দিকে সাভারের এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আইসিইউতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়।
মৃত ওই প্রসূতির নাম হোসনে আরা আক্তার (২৫)। তিনি সিংগাইর উপজেলার বলধারা ইউনিয়নের বড় কালিয়াকৈর গ্রামের সৌদি প্রবাসী বাদশা মিয়ার স্ত্রী। গত (২১ এপ্রিল) সোমবার রাত ৮টার দিকে মুন্নু মেডিকেলে তার সিজার করা হয়। এ সময় তিনি দুটি কন্যা সন্তানের জন্ম দেন। এছাড়াও হোসনে আরা-বাদশা মিয়ার আড়াই বছরের এক ছেলে সন্তান রয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ৯ মাসের অন্তঃসত্ত্বা হোসনে আরা অধ্যাপক ডাক্তার জগলুল হায়দারের তত্ত্বাবধানে ছিলেন। প্রাথমিক পর্যায়ে আল্ট্রাসনোগ্রাফিতে দেখা যায়, তার গর্ভে চারটি সন্তান রয়েছে। একসঙ্গে চারটি সন্তান ধারণ করলে তার শারীরিক ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা থাকায় চিকিৎসক তাকে দুটি সন্তান নষ্ট করার পরামর্শ দেন। একইসঙ্গে তিনি যাবতীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করেন ও নিয়মিত ফলোআপে রাখেন। বিষয়টি জটিল হওয়ায় তিনি হোসনে আরাকে তাঁর পরামর্শ ছাড়া অন্য কোনো হাসপাতাল কিংবা চিকিৎসকের কাছে চিকিৎসা না নেওয়ার পরামর্শ দেন।
গত ২১ এপ্রিল হঠাৎ হোসনে আরা গর্ভের ব্যথা অনুভব করলে তার দেবর রনিকে নিয়ে দুপুরে মুন্নু মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যান। এ সময় অধ্যাপক ডাক্তার মাহবুবা হোসনে আরার শারীরিক অবস্থা বিবেচনায় তাকে হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পরামর্শ দেন। ডাক্তার মাহবুবার পরামর্শ মতে, হোসনে আরা মুন্নু মেডিকেলে ভর্তি হন। ওইদিন রাত ৮টার দিকে গাইনি সার্জন অধ্যাপক ডাক্তার সিলভিয়া তার সার্জারি করেন। সেসময় দুটি কন্যা সন্তান জন্ম দেন হোসনে আরা।
হোসনে আরার ননদ রোজিনা বলেন, আমরা মুন্নু মেডিকেলে শুধুমাত্র ডাক্তার দেখাতে এসেছিলাম। অপারেশন করাতে চাইনি। ডাক্তার মাহবুবাকে দেখানোর সময় হোসনে আরার সব সমস্যার কথা খুলে বলেছিলাম। এরপরও তিনি মুন্নু মেডিকেলেই অপারেশন করতে বলেন। তখন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ আমাদের আশ্বস্ত করেছিল রোগীর কোনো সমস্যা হবে না।
হোসনে আরার খালা হাজেরা বলেন, সিজারের পর হোসনে আরার শারীরিক অবস্থা খারাপ হতে থাকে। এরপর শুরু হয় ডাক্তারদের নানা ধরনের আনাগোনা। কিন্তু এরপরও রোগীর স্বজনদের কাউকে ভিতরে ঢুকতে দেয়নি। এমনকি তাদের কিছু জানানোও হয়নি। এরপর আরও ডাক্তার আসেন। সারারাত হোসনে আরার চিকিৎসা করেন। তিন ব্যাগ রক্ত দেওয়া হয়।
তিনি আরও বলেন, পরদিন সকাল পর্যন্ত যখন হোসনে আরার অবস্থার উন্নতি হচ্ছিল না। তখন আমরা ডাক্তারদের বলি রোগীর কিছু হলে আপনাদের বিরুদ্ধে আমরা আইনগত ব্যবস্থা নেব। তখন তারা হোসনে আরাকে সাভারের এনাম মেডিকেলে রেফার্ড করেন। এনাম মেডিকেলে নেওয়া হলে সেখানকার ডাক্তাররা আমাদেরকে জানান, আপনারা তো রোগীকে মেরে ফেলে তারপর নিয়ে এসেছেন। তারা হোসনে আরাকে আইসিইউতে ভর্তি করেন। তখনো রক্ত দেওয়া হচ্ছিল। কিন্তু সব রক্ত শরীর থেকে বের হয়ে যাচ্ছিল। এনাম মেডিকেলে হোসনে আরাকে আরও পাঁচ ব্যাগ রক্ত দেওয়া হয়।
এনাম মেডিকেলের চিকিৎসকরা আমাদেরকে জানান, হোসনে আরার আরও একটা অপারেশন করা দরকার। কিন্তু তার শারীরিক অবস্থার কারণে তা করা সম্ভব হচ্ছিল না। এরপর চিকিৎসাধীন অবস্থায় রাত ৯টায় হোসনে আরা মারা যান।
এদিকে, এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে দেওয়া হোসনে আরার ডেড সার্টিফিকেটে মৃত্যুর কারণ হিসেবে ‘সেপটিক শক’ লেখা রয়েছে। চিকিৎসকের ভাষায় এটা মারাত্মক জটিলতা।
অপরদিকে, হোসনে আরার জীবন সংকটাপন্ন জানার পরই তার চিকিৎসা সংক্রান্ত সকল কাগজপত্র নিজেদের কাছে নিয়ে নেয় মুন্নু মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। যদিও চিকিৎসা সংক্রান্ত কাগজপত্র থাকার কথা রোগীর স্বজনদের কাছে। অর্থাৎ আইনি জটিলতা এড়াতে নথি গায়েবের চেষ্টা করেছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। ফলে হোসনে আরার চিকিৎসা সংক্রান্ত তথ্য জানতে মুন্নু মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গেলে নানা টালবাহানায় তথ্য না দিয়ে হয়রানি করে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। অবশেষে হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) ডাক্তার জুলফিকার আহমেদ আমিন গণমাধ্যমকর্মীদের সঙ্গে কথা বলেন। তিনি জানান, মুন্নু মেডিকেলে আইসিইউ সাপোর্ট না থাকায় রোগীকে বাঁচানো সম্ভব হয়নি। আর এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালেও যদি দ্রুত আইসিইউ সাপোর্টে নেওয়া হত, তবুও রোগীকে বাঁচানোর সম্ভাবনা ছিল।
ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) ডা: জুলফিকার আমিন জানান, হোসনে আরার গর্ভের চারটি সন্তানের মধ্যে দুটি নষ্ট করায় এমনিতেই তিনি স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে ছিলেন। এছাড়া গত সোমবার তাকে আল্ট্রাসনোগ্রাফি করে দেখা যায়, একটি বাচ্চা পায়খানা করেছে। ফলে তার সিজার করা জরুরি হয়ে পড়ে। সিজারও স্বাভাবিকভাবে সম্পন্ন হয়। কিন্তু রাত ১২টা নাগাদ হোসনে আরার প্রেসার ফল করে। ক্রমাগত রক্তপাত হয়। এরপর আমাদের আরও বিশেষজ্ঞ ডাক্তাররা আসেন। তাকে সর্বোচ্চ চিসিৎসাসেবা দিয়ে বাঁচানোর চেষ্টা করা হয়। শেষ অবধি তার আইসিউ সাপোর্ট জরুরি হয়ে পড়লে তাকে আইসিইউ সাপোর্টের জন্য ঢাকায় রেফার্ড করা হয়।
রোগীর স্বজন ও মুন্নু হাসপাতালের পরিচালকের কথা অনুযায়ী, সময়মতো আইসিইউ সাপোর্টে নেওয়া হলে হোসনে আরাকে বাঁচানো সম্ভব ছিল।
এ বিষয়ে মানিকগঞ্জের সিভিল সার্জন (ভারপ্রাপ্ত) আনিসুর রহমান বলেন, বিসয়টি আমার জানা নেই, এ ঘটনায় এখনো কেউ কোনো অভিযোগ করেনি। অভিযোগ পেলে তদন্ত করে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।